গল্পঃ ছোট এই জীবন। সুন্দর একটি গল্প।
-আপনার স্ত্রী কি সুন্দরী?
-জ্বি
-কম না বেশি ?
জামাল সাহেব এই প্রশ্নের উত্তরে গাঁ দুলিয়ে হাসছেন।তিনি বললেন,
-পাশে ঝুলানো ছবিটা তার।
আজমল সাহেব বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কারণ তিনি তার বিশ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে এমন রূপবতী কাউকে দেখেন নি! আশ্চর্য তো! কারো চোখে কি এতটা মায়া থাকতে পারে? স্ত্রী এমন রূপবতী হলে স্বামী তার প্রেমে পড়ে লেখক হবে এটাই স্বাভাবিক! খানিকক্ষণ দেখার পর নিজেই নিজের প্রতি লজ্জিত বোধ করলেন। মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন,
-তার সাথে আপনার পরিচয় কিভাবে?
-আসলে আমাদের বিয়েটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। আমি,আমার মা আর ছোট বোন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন আর তার সাথে দেখা হয় নি।
-কিন্তু কেন!
-ও ভীষণ লাজুক প্রকৃতির। তাই আমাদের সামনে আসতে পারছিল না। আমার অবশ্যি মনে হয়েছিল ও সেদিন আড়াল থেকে আমাদের দেখছিল। তবে এটা আমার ভ্রম ও হতে পারে। মা ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন ব্যাপারটায়। তিনি আমার বিয়ে সেখানে দিতে চান নি।কিন্তু আমিই কোন অজানা মায়ার তাড়নায় মাকে রাজি করালাম। কেন সেদিন ঐ মেয়েটার জন্য আমার মন কাঁদছিল আমি জানি না। আড়াল থেকে দেখা তার কৌতুহলী চোখের জন্য? নাকি কোন গভীর আবেগ আমাকে তাড়িত করছে? নিজেকে প্রশ্ন করতে লাগলাম। পরের দিন আমি একাই গেলাম তাদের বাড়িতে। ছাদে তার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। একাই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার শালিকাদের হাসির শব্দ ভেসে আসছিল। হয়ত লুকিয়ে আমাকে দেখে তারা হাসি-তামাশা করছিল।তাতে অবশ্যি কিছু যায় আসে না। শালিকা-দুলাভাইয়ের সম্পর্ক তো এমনই। হঠাৎ এমন সময় নূপুরের ঝনঝন শব্দ কানে ভেসে আসল। সেই শব্দেও কি অদ্ভুত একটা সুর! আজো আমার কানে ভাসে..... পেছন ফিরে তাকাতেই চোখ পড়ল সেই মায়াবতীর ওপর। বেশি সাজগোজ নেই। সামান্য সূতি শাড়ি, কপালে কালো টিপ আর চোখে হালকা কাজল। শাড়ির রঙটা ঠিক খেয়াল করি নি। কিভাবেই বা খেয়াল করতাম? তার চোখের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম সর্বক্ষণ। মনে হচ্ছিল ওই চোখের দিকে তাকিয়ে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারব!
আজমল সাহেব এবার খানিকটা বিরক্ত বোধ করছেন। দেখা হওয়ার মত এত সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে এত আলগা ফ্যাদলা পারার কি আছে কে জানে!
জামাল সাহেব বলেই যাচ্ছেন অনবরত,
-ওকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছিল। বিয়ের পর আমি ওকে নিয়ে ঢাকায় আলাদা ফ্লাটে শিফট হই। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ছিলাম। পরে অবশ্য চাকরিটা ছেড়ে দেই।
-ওমা! ছেড়ে দিলেন কেন?
-বলছি বলছি। সেটা আরো পরের কাহিনী। বিয়ের বছর দুয়েক পর আমার আর রিনার জীবনে আসে ছোট্ট পরী কুহু।
-তাহলে আপনার ওয়াইফ মারা যান কিভাবে?
-কুহুর জন্মের সময়ই। কুহুর জন্মের সময় রিনার গগনবিদারী চিৎকার আর কেউ শুনতে না পেলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল।
-এক মিনিট! তার চিৎকার কেউ শুনতে পায় নি মানে??
-আমার ওয়াইফ কথা বলতে পারত না। শি ওয়ায ডিফ এন্ড ডাম্ব।
আজমল সাহেব খানিকটা কষ্ট পেলেন। কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না। শুধু বললেন,
-সো স্যাড।
জামাল সাহেব বললেন,
-তারপর ইউনিভার্স্টির চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে লেখালিখি শুরু করি আর এই ছোট্ট ফ্ল্যাটটা নিয়ে আমি আর আমার মেয়ে থাকি। আপনি আমার জীবন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলেন না? তাহলে বলি আমার জীবন সেদিনই প্রকৃত অর্থে শুরু হয়েছিল যেদিন রিনা আমার লাইফে আসে। আর ওর মৃত্যুর সাথে সাথে সেই জীবন, সেই সুন্দর দিনগুলোর সমাপ্তি ঘটে। এখন বেঁচে আছি শুধুমাত্র আমার মেয়েটার..........
এমন সময় একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকল। ৫-৬ বছর হবে বয়স। ভীষণ রূপবতী। নিঃসন্দেহ কুহু। একদম ওর মায়ের মত হয়েছে দেখতে! সে এসে জামাল সাহেবের কোলে উঠে বসল। বাবা - মেয়ে হাতের ইশারায় কথা বলছে। মেয়ে কিছু একটা বলছে আর বাবা হাত নেড়ে তার উত্তর দিচ্ছে। এক পর্যায়ে তারা হাসতে লাগল। হাসছে দুজনই কিন্তু হাসির শব্দ ভেসে আসছে শুধুমাত্র জামাল সাহেবের। আজমল সাহেব একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ কখন ভিজে গেছে তিনি তা জানেন না! ভালবাসা আসলে কখনো মরে না, কক্ষনো না!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন