গল্পঃ পাগল।
"চার রাস্তার মাথায় একটি বিবস্ত্রহীন এক নারীর লাশ পাওয়া গিয়েছে"
পত্রিকার হেডলাইনটা দেখে বেশ আগ্রহ জাগলো পুরো প্রতিবেদনটা পড়ার৷
" গতকাল রাত ১০ টার সময় ঢাকার নিউমার্কেট সংলগ্ন একটি চিপা রাস্তার মাথায় একটা নারীর লাশ পাওয়া গিয়েছে৷ এই সময় মেয়েটার শরীরে কোনো রকম পোশাক ছিলো না৷সেখানকার স্থানীয় এক যুবক ঘটনাটি দেখার পর পুলিশকে জানায়৷ পুলিশ তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়৷ মেয়েটার খোজ নিয়ে জানা গেছে তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আকবর মোল্লার বড় মেয়ে সোনিয়া। মেয়েটাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে এবং এটার পোস্টমর্টেম এর দ্বায়িত্বে আছেন ডঃ আজমল মাহমুদ। পুলিশ জানিয়েছে পোস্টমর্টেম আসলেই জানা যাবে খুনের আসল রহস্যটা কি। "
এতোটুকু পড়ার পর আর পড়ার প্রতি ইচ্ছা জাগলো না৷ পত্রিকাটা গুছিয়ে টেবিলের একপাশে রেখে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলাম৷ প্রচন্ড সিগারেটের নেশা ধরেছে৷ পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে দেখলাম সেখানে কোনো সিগারেট নেই। এমনটা হবার কথা নয় গতকাল রাতে পুরো ১ প্যাকেট সিগারেট কিনে রেখেছিলাম৷ কোথায় গেলো? এখন খোজার সময় নেই সিগারেট খেতেই হবে। রুম থেকে বের হয়ে রফিকের চায়ের দোকানে এসে বসলাম৷
- রফিক একটা সিগারেট দাও আর কড়া লিকার দিয়ে হালকা একটা দূধ-চা বানিয়ে দাও।
সিগারেটটা ধরাবার সময় দেখলাম রফিকের চায়ের দোকানে বসে থাকা আরও ২ জন লোক আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে৷ আমি কি সকালে মুখ ধূয়ে বের হয়নি? না বোধ হয় চোখে এখনও ঘুম ঘুম ভাব এটার জন্যই হয়তো তারা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
- ভাই একটা কথা বলি ( পাশের লোকটা বলে উঠলো)
কিছু বললাম না সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লাম৷ আমি যদি তাকে না বলি সেও আমাকে কথাটা জিজ্ঞেস করবে যেটা তার মুখ দেখেই বলে দেওয়া যায়৷
- এই নেন ভাই আপনার চা৷
চায়ের কাপে চুমুক দেবার সাথেই লোকটা বলে উঠলো
- ভাই কড়া করে হালকা দূধ-চা আবার কিভাবে হয়?
লোকটা বেশ আগ্রহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তর পাবার আশায়৷
- কি ব্যাপার রফিক চায়ে চিনি দাওনি যে?
- ভাই আপনি তো চিনি হালকা খান তাই কম করে দিয়েছি৷
- ব্যাপার না একটু বেশি কড়া হয়ে গিয়েছে আর একটু চিনি দাও।
লোকটা এখনও আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে৷ চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে রফিককে বিলটা দিয়ে আসার আগে লোকটা বললাম
- আপনার উত্তরটা অন্য কোনো দিন দিবো।
লোকটা হয়তো আমার দিকে অবাক হবার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন৷ নয়তো রফিককে জিজ্ঞেস করছেন আমি পাগল কিনা? সে যেটায় হোক সেটা জানার আগ্রহ দেখালাম না। দ্রুত আকবর মোল্লার বাসায় যেতে হবে একটু। তার মেয়ের খুন হয়েছে সেই সাথে রাস্তার মাঝখানে তাকে উলঙ্গ করে ফেলে রাখা হয়েছে৷ এতে লোকটা যেমন কষ্ট পেয়েছেন সেই সাথে তার ইজ্জত নিয়েও টানাটানি পড়েছে৷
আকবর মোল্লার বাড়ির গেটের ভিতরে প্রবেশ করতেই বুঝলাম বাড়িটায় এক শুনশান নিরবতা বিরাজ করছে৷ এখানকার আবহাওয়া বলে দিচ্ছে এটা একটা মৃত বাড়ি৷ তবে মৃত বাড়ির চিত্রটা এমন হয়না৷ চারপাশে কোনো মানুষকেই তেমন দেখা যাচ্ছে না৷ পরিবারের লোক বোধ হয় এখনও মেডিকেলে রয়েছে। লাশটার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এখনও বের হয়নি যার জন্য তারা তার মেয়েকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারছেনা না৷ তবে আকবর মোল্লা বাড়িতে আছে তার সাথে রয়েছে তার বয়সী কিছু ব্যাক্তি৷ এগুলো তার সহকারী বা বন্ধু বলা যেতে পারে। তাকে বোধহয় শান্তনা দিতে এসেছেন৷ আকবর মোল্লা আমাকে দেখে মনে হয় খুশি হলেন না৷ মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলেন৷ অবশ্য এটা হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ বছর খানেক আগে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো। রাস্তার পাশ দিয়ে চলার সময় দেখেছিলাম তিনি এক বৃদ্ধ বয়সী মহিলাকে ধাক্কা দিয়েছিলেন৷ কারণ মহিলাটি তার কাছে সাহায্য চেয়েছিলো আর তিনি তখন ফোনে কথা বলছিলেন৷ তার কথা বলা দেখেই বোঝা যাচ্ছিলো কোনো সমস্যা হয়তো তার পরিবারে বা কারও সাথে তার কোনো ঝামেলা যার কারণেই তিনি বিরক্ত হয়ে তাকে সরাতে গিয়ে এক প্রকার ধাক্কা দিয়েছিলেন৷ এই বিষয়টা নিয়ে সেদিন তাকে অনেক গুলো কথা শুনিয়েছিলাম৷ তিনি কি এখনো আমাকে মনে রেখেছেন সেদিনপর ঘটনার জন্য?রাখাটাই স্বাভাবিক সাধারণত এমন ধরনের মানুষ তাদের পথে যদি কেউ দু'টো কথা শুনিয়ে দেয় তাদের কে সহজে ভুলেন না৷
একটা চেয়ার নিয়ে তার সামনা-সামনি বসলাম৷
- কি চান ( বেশ গাম্ভীর্যের সাথে)
- এমনিই দেখা করতে আসলাম। পত্রিকায় খবর দেখলাম আপনার মেয়ের...
পুরো কথাটা শেষ করার আগেই তিনি আমাকে থামিয়ে বলতে শুরু করলেন৷
- দেখুন আপনি যা পড়েছেন ভালো কথা৷ এখন এখানে কি জন্য এসেছেন সেটা বলুন। এমনিতেই আমার মন মেজাজ ভালো নেই খারাপ কিছু হবার আগেই এখান থেকে বিদেয় হন৷
- দেখুন আমি আসলে আপনার মেয়ের বিষয়টা জানতে....
আবারও থামিয়ে দিলেন।
- আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাইছি মা৷ দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না৷ এখন আসুন।
আকবর মোল্লা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আমি আর কথা বাড়ালাম না৷ বুঝতেই পারছি তিনি বেশ শোকের মাঝে আছেন৷ এই সময় তার সাথে কথা বলতে চাওয়া মানে উল্টো কথা শোনা৷
একটু ঢাকা মেডিকেলে যেতে হবে৷ আজমল মাহমুদ এর সাথে দেখা করা দরকার৷ আজমল আমার কলেজ জীবনের বন্ধু৷ তার ইচ্ছা ছিলো সে বড় হয়ে ডাক্তার হবে আর আমার কিছুটা রহস্য বা অজানা কিছু জানার প্রতি বেশ আগ্রহ সেই শার্লক হোমস পড়ার পর থেকে তাই আমি পড়ালেখা শেষ করে যোগ দিলাম গোয়েন্দা বিভাগে আর সে ডাক্তারি পড়ার জন্য বিদেশ চলে গেলো৷ আর এখন সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডাক্তার৷ গোয়েন্দা বিভাগের চাকরিটা এখন আমার আর নেই৷ আমিই ছেড়ে দিয়েছি সব সময় উপর থেকে যা বলবে সেই কেসটাই হাতে নিতে হবে৷ এটা আমার পছন্দ না৷ যার জন্য আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও নতুন কিছুর সন্ধানে যেতে পারতাম না আর এজন্যেই চাকরিটা ছেড়ে এখন নিজের ইচ্ছা মতো সব কিছু করে চলি৷
ঢাকা মেডিকেলে ঢুকে আজমল এর চেম্বারে যাবার পথেই জলিল মিয়ার সাথে দেখা৷ তার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম এই কেসটার ইনচার্জ হিসেবে তিনি রয়েছে৷
- তুমি এখানে কি করছো?
- আজমল এর সাথে দেখা করতে ভাবলাম যদি এই কেসটাতে কোনো রকম সাহায্য করতে পারি৷
- কিন্তু তুমি তো চাকরি ছেড়ে দিয়েছো৷
- চাকরি বড় বিষয় না অনুসন্ধান করাটাই হলো কথা আর যেটার জন্য দরকার আগ্রহ৷ আপনি যদি বলেন তো আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি৷
- ঠিক আছে সমস্যা নেই তোমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমি অবগত৷ যাও আজমল ভেতরেই আছে৷
- ধন্যবাদ আপনি আসবেন না?
- না আমি একটা সিগারেট খেয়ে আসি অনেক্ক্ষণ হলে সিগারেট খাওয়া হয় না৷
চেম্বারে প্রবেশ করেই দেখলাম আজমল বেশ হতাশ ভাবে চেয়ারে বসে আছে৷ তাকে দেখে বেশ চিন্তিত মনে আছে৷
- আসবো?
- হ্যা ভিতরে এসে বোস৷ ভালোই হলো তুই এসেছিস তোর কথাই ভাবছিলাম৷
- কেনো কি হয়েছে দেখে মনে হচ্ছে তুই অনেক চিন্তিত৷ তাছাড়া ওই মেয়েটার কি খবর যেটার পোস্টমর্টেম এর দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো৷ মেয়েটাকে রিলিজ করিস নি এখনো?
- আস্তে আমি তোর সব কথারই উত্তর দিবো তবে তার আগে একটু আমার সাথে চল৷
আজমল সামনে হাঁটছে আমি তার পিছু৷
সে আমাকে নিয়ে পোস্টমর্টেম রুমে নিয়ে আসলো৷
- তুই একটু নিজের চোখে দেখ৷
বলেই আজমল মেয়েটার শরীর থেকে সাদা কাপড়টা সরিয়ে ফেললো৷ মেয়েটার শরীর সাধা বর্ণ ধারণ করেছে৷ তার শরীরের চামড়া গুলো শুকিয়ে ভাজ পড়ে গিয়েছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তার শরীরে বিন্দু পরিমাণও রক্ত নেই৷
আজমল আবারও সাদা কাপড়টা দিয়ে শরীরটা ঢেকে দিলো৷
- আমি আমার লাইফে এমন কেস কখনই পায়নি।
কথাটা শেষ করেই আজমল এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো।
- খুনটা কেনো করা হয়েছে সেটা জানতে পেরেছিস?
- না তবে কিভাবে মারা গিয়েছে সেটা বের করতে পেরেছি! রক্ত শূণ্যতার অভাবে মারা গিয়েছে মেয়েটা৷
- মানে?
- মানে খুব সোজা মেয়েটার শরীরে রক্ত না থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে?
- এটা কিভাবে সম্ভব কোনো ক্ষত বা চিহ্ন যার জন্য মেয়েটার শরীর থেকে রক্ত উধাও হয়ে গিয়েছে?
- না তেমন কোনো ক্ষত তার শরীরে নেই।
- ধর্ষণের কোনো চিহ্ন?
- না তবে তোকে একটা কথা বলি এটা কোনো মানুষের কাজ না৷
আমি কথাটা কানে নিলাম না৷
- দেখ অনিকেত আমি মজা করছি না এটা কোনো মানুষের কাজ হতেই পারে না৷ তা নাহলে এমনি এমনিই মেয়ের শরীরে রক্ত শূণ্যতা দেখা দিবে কিভাবে৷ আর ধর্ষণ বা ক্ষত এর কোনো চিহ্ন নেই এটাকে তুই কি ভাবিস?
- আজমল তুই ডাক্তার একটু ভেবে চিন্তে কথা বল তোর মুখে এসব মানায় না৷ মানে তুই বলতে চাচ্ছিস এসব কিছু মানুষ না অন্য কিছু করেছে?
- হ্যা
- আচ্ছা চেম্বারে চল বসে কথা হবে৷
আজমল বেশ হতাশ হলো৷ আমি যে তার কথা বিশ্বাস করছি না সে এটা ভেবে আরও হতাশ হয়েছে৷ আচ্ছা এটাও কি সম্ভব? এমনি এমনিই রক্ত শূণ্যতা দেখা দেওয়া? নাকি ভুত বলতে কোনো জিনিস আছে?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন