জীবনের ভালোবাসা
পর্ব ০৫
সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পরলাম। তারপর থেকে প্রতিদিন সময়মত আমাকে খাইয়ে দেয়া, সবসময় পাশে থাকা আর আমার সব সেবাতে নিজেকে উৎসর্গ করলো রাজ।
ওর সেবায় আর ডক্তরের চিকিৎসায় ৭ দিন পর আমি সুস্থ হয়ে উঠলাম।সেদিন ছিলো সোমবার ও অনেক রাতে বাসায় আসলো।ওর মুখে আবারো সেই দুর্গন্ধ। আবারো সেই অশান্তি। আমার দিনগুলো এরকম অশান্তিতেই চলতে লাগলো।আমিও ওরকম করেই নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে চাইছিলাম।
কারণ আমি ভয় পাচ্ছিলাম যে আমার আব্বু এগুলো শুনলে আম্মুকে নানাভাবে অত্যাচার করবে।আমার ভুলের শাস্তি কেনো আমার মা পাবে।এটা ভেবেই সব মুখ বুজে সহ্য করছিলাম।৪-৫ দিন হয়ে গেলো আমি আর রাজকে এসব সম্পর্কে কিছু বলি না।এর মধ্যে আমার ভাই আমাকে শীতের পিঠা খাওয়ানোর জন্য বাড়িতে নিয়ে আসলো।
বিকেলের দিকে রাজ ওচলে এলো।রাতটা ভালোই কাটলো।কারন সেদিন ও নেশায় আসক্ত ছিলো না।হয়তো মাদকদ্রব্য পায় নি নয়তো শ্বশুরবাড়ি এসেছিলো বলে।
সকালবেলায় রাজ শার্ট প্যান্ট পড়ে কোথাও যেন বেরোচ্ছিলো।আমি ওকে বললাম।
- বিকেলে আম্মুকে ও লিজা, আখি, বায়েজিদ কে নিয়ে এসো।
- কেনো ওদের নিয়ে আসবো?
কেউ আসবে না তাই।
- কিন্তু কেনো?
- প্রশ্ন কম কর।
- কি হয়ছে বলবা তো।
- কিছু না।
- ভালো কথা।তুমি ওদের নিয়ে এসো আর ভাইয়াদের আসতে বলো।
আমার এই কথাতে ও একটু বেশিই রেগে যায়।
- তোর বাপের এই ভিখারির মতো দাওয়াতে কেউ আসবে না।
- দেখো আমার আব্বু এতোটাও ধনী নয় যে তোমাদের বাড়ির সকলকে সব সময় দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে।
এটা নিয়ে কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো।
আমি আব্বুর সিদ্ধান্ত কে সমর্থন করেছিলাম।কারনটা অবশ্য অনেকটা দারিদ্রতা। ওদের বাড়িতে ছোট বড় মিলে প্রায় ৫৫- ৬০ জন মানুষ। তো ওদের সবাইকে দাওয়াত করলে আমার বাকি আরো চার বোনের শ্বশুরবাড়ির ও লোক সহ কমপক্ষে ২০০ লোক হতো।আমার আব্বুর পক্ষে এতো খরচ বহন খুবই কঠিন ছিলো।
.
আব্বু তবুও ওদের বাড়ির ২০ জন কে দাওয়াত করেছিলো।
কিন্তু তাতে ওর মন ভরেনি।হয়তো ওর বাড়ির কারো ই মন ও ভরেনি বলে রাগটা ওর বেশি হয়ে গেছিলো।তর্ক করতে করতে একসময় ও আমাকে একটা থাপ্পড় মারে।থাপ্পড়টা এতো জোরে মেরেছিলো যে আমার কানে লেগে কান দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করে।আমি ঝোক সামলাতে না পেরে জোরে জোরে কান্না করছিলাম।আমার কান্না শুনে আব্বু ভাবি, মা, আপুরা সহ অনেকে আসে। সবাই ওরকম রক্ত পড়া দেখে ওকে বকতে শুরু করে।আমার বিয়ের তখন সবেমাত্র ১মাস ১৭ দিন চলতেছে।একেক জন একেক কথা বলতেছে।আব্বু কেবল শান্তভাবে ওকে জিজ্ঞাসা করে
- কেনো মারলে ওকে?
- আমার টাকা নিয়ে পারাপারি করছিলো।আমি কেড়ে নেওয়াতে আমাকে মা বাবা তুলে গালি দিয়েছে তাই..
খুব সহজ করে মিথ্যেটা বলে দিলো।
- তোকে কি আমি এই শিক্ষায় বড় করেছি। যে তুই অন্যের মাকে বকিস।
-না আব্বু।(বলতে গিয়ে আমার মনে পড়ে গেলো আব্বু বিয়েটা দিতে চায় নি।তাই আর বললাম না)আব্বু আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। ওকে বললো খেয়েদেয়ে যাও। বিকেলে সবাইকে নিয়ে এসো।ও খেয়েদেয়ে চলে গেলো।আমরা সবাই খেতে বসছিলাম। আব্বু আমাকে উনার পাশে বসালো।খাওয়া প্রায় শেষ এমন সময় আব্বু আমার ভাতসহ হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলো আমি সুখে আছি কিনা।
আমি একদম চুপ,না পারছি ভাত হাতে নিয়ে মিথ্যে বলতে না পারছি সত্যিটা সবার সামনে বলে ওকে ছোটো করতে।
সাথে ওই ভয়টা ও কাজ করছিলো।যদি সব শোনার পর আম্মুকে আমার জন্য কোনোরকম কষ্ট পেতে হয়।এবার আব্বু বললো,
- তুই যদি ভাবিস সব গোপন করে যাবি আর নিজেকে আরো কষ্টের মুখে ঠেলে দিবি তাহলে ভুল ভাবছিস।আমি সেটা হতে দেবো না।তোদের যে আমি খুব কষ্টে মানুষ করছিরে মা।তুই না হয় আবেগের বশে ছোট্ট একটা ভুল করেছিস। তাই বলে কী আমি সব জেনেশুনে তোকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবো।নারে মা তোর বাপটা এতোটা খারাপ না,যে তার মেয়ের ছোট্ট একটা ভুলের জন্য সারাজীবন পস্তাতে হবে।
এবার আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।
- ভাবি এসে সব বলে দিলো আব্বুকে।আব্বু তো রেগে আগুন।
- মারে শোন তোর বাপ বেছে থাকতে তোর একটু কষ্ট ও আমি সহ্য করবো না। এবার যা হাতমুখ ধুয়ে নে। আর হ্যা আশা করি আর আমার অবাধ্য হবি না।
- আমি কাঁদতে কাঁদতে অন্য রুমে চলে গেলাম।এতোদিনে মনটা একটু হালকা হলো।
বিকেলে রাজ ওর বাবা,মা,ও ভাতিজি, ভাতিজা এলো।আমি সবাইকে বাড়ির ভিতর নিয়ে এসে বসতে দিলাম।পরের দিন সকালে খাওয়াদাওয়া শেষে রাজ আমায় রেডি হতে বললো। কিন্তু আমি ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বিভিন্ন কাজে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেললাম।আব্বু সবার জন্য উপহার নিয়ে এসে হাতে দিলো।
আমার শ্বাশড়ী আর শ্বশুর আব্বুর দেওয়া পোষাকে নিজেদের আবৃত করলো।
রাজ এবার ও আমায় বলছে
- কি হলো রেডি হচ্ছো না কেনো?
একথা শুনে আব্বু আমার শ্বশুরমশাই কে ডেকে নিয়ে এসে বললো...
-ভাই মেয়েটা তো অনেকদিন পর বাড়িতে আসলো।তো কয়েকটা দিন রেখে গেলে ভালো হতো।
আমার শ্বশুরমশাই ও রাজি হয়ে গেলেন।
কিন্তু আমার স্বামী মানতে নারাজ।এমন ভাব দেখাচ্ছিলো যেনো ও আমায় চোখে হারায়।
সেদিন আব্বু ওর ঘটানো সব কুকির্তীর কথা বলে ওর বাবা মাকে কষ্ট দিতে চায়নি।
আব্বু নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকলো।
- রাজ এবার ওর আম্মুর পড়া কাপড় টেনে খুলে আব্বুর মুখের ওপর ছুড়ে মারলো।এবার আব্বু বলে দিলো আর কোনোদিন আমার মেয়েকে ও বাড়িতে পাঠাবো না আপনারা চলে যেতে পারেন।
আমার শ্বশুরমশাই বড় হয়েও আব্বুর কাছে ক্ষমা চাইলো। আব্বু এবার একে এক সব কথা বলে ফেললো।
শ্বশুরমশাই কথাগুলো মানলেও আমার শ্বাশুড়িমা এমন ভাব নিলেন যেনো উনার ছেলের আচরন ফেরেস্তাসুলভ উনি এগুলো করতেই পারেন না।
রাজ সেদিন অনেক কেঁদেছিলো।সেদিন প্রথম আমি কোনো ছেলের কান্না দেখেছিলাম।কেনো কেঁদেছিলো জানি না। হয়তো কান্না দিয়ে ওর করা কুকীর্তি গুলো ঢাকার জন্য।নয়তো আমাকে হারাতে চায়নি বলে।ওর কান্না দেখে অনেকেই আমাকে বলতে লাগলো যে আমি সব মিথ্যে বলেছি।আবার যারা আমায় ছোটোবেলা থেকে চেনে তারা ওকে কথা শুনিয়ে চলে গেলো।
শেষ অবধি ওরা একাই চলে গেলো।
যাওয়ার পর থেকেই ও আমাকে সহ আমার বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষের কাছে কল দিতো শুধু আমার সাথে কথা বলার জন্য।কিন্তু কেউ আমায় কথা বলতে দেয় নি।এমন কি আব্বুর আদেশে আমার ফোনটাও আমার হাত থেকে বড়ভাইয়া কেড়ে নিয়েছিলো।এই ভয়ে যে আমি যদি ওর সাথে কথা বলে দুর্বল হয়ে পড়ি সেই ভয়ে।
এমনি করে ৭-৮ দিন কেটে গেলো।তারপর ওর চাচাতো ভাই যিনি মেম্বর ছিলেন।উনি আমাদের বাড়িতে আসলো।এসে আব্বুকে অনেক বুঝিয়ে এই কথা দিয়ে আমায় নিয়ে গেলো যে পরবর্তী কোনো ঝামেলা হবে না।আর যদি হয় তাহলে আমি নিজে আপনাকে খবর দিয়ে নিয়ে আপনাদের মেয়েকে আপনার হাতে তুলে দেবো।
আমি বাড়ি থেকে ১টিন মুড়ি,ইলিস মাছের তরকারি, রান্না করা গরুর মাংস আর পোলাও নিয়ে গেলাম। যেতে যতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রাতে আমি ওকে ওগুলো খেতে দিলাম কিন্তু ও খেলো না।না খেয়ে ওর মাকে বললো ওর বাপের বাড়ির ১টা জিনিস যেনো আমার ঘরে না থাকে।
- থাকবে না কেনো?পুরোনো সব কি ভুলে যাওয়া যায় না?
- কি ভুলে যাবো? গ্রাম ভর্তি মানুষের সামনে আমাকে অপমান করা।নাকি পিঠে খাওয়ানোর নামে আমার বাপ মায়ের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা।
- এগুলো শোনানোর জন্য কি আমাকে আনা হয়েছে?
কথাটা বলতে না বলতেই ওর বোন আসলো।এসে আমাকে যা ইচ্ছে তাই বললো।সেরাতে আর কিছু খেলো না। সকাল বেলা আমি রান্না করতে ছিলাম।এমন সময় আমার ফোন এ কল আসলো।আমি রিসিভ করে কেবলি আম্মু বলেছি ওমনি ও রুম থেকে উঠে এসে ফোন আছার দিয়ে ভেজ্ঞে ফেললো।আমি কিছু না বলে ওই ভাইয়ার কাছে গিয়ে সব বলে আসলাম।এইটাই যেনো আমার জীবনের কাল হয়ে গেলো।আমি আসতে না আসতেই ওর বড় বোন বললো নতুন বউয়ের সাহস তো কম নয়।
- কোন সাহসে তুমি পা বাড়ালে।তোমার ভাগ্য ভালো যে আমার ভাই তোমাকে কিছু বলছে না।
- বাহ! আপা আপনি তো দারুন।আপনার মতো বোন ঘরে ঘরে থাকা দরকার।নাহলে তো ভাইবউরা মানুষ হবে না।(ব্যংগ করে কথাগুলো বললাম আমি।
- কিরে হারামজাদা এখনো দাড়িয়ে থাকবি। তোর জায়গায় আমি হলে কেটে টুকরো টুকরো করতাম।কি করে এতো সাহস পায় দেখতাম।
কথাটা বলতে না বলতেই ও একটা লম্বা বাটাম(কাঠের টুকরো) এনে আমায় ইচ্ছে মতো পেটালো।সামনে ওর বোন ছিলো। কিন্তু ঠেকালো না। রাতে না খেয়ে।আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।আমার শ্বাশুড়িমা অবশ্য খেতে বলেছিলো কিন্তু আমি খাইনি।সকাল বেলা ও খেয়েদেয়ে কাজ এ গেলো আমি ডায়রি খুজছিলাম লেখার জন্য।কিন্তু ডায়রিটা খুজে পেলাম না।পরে আমার বড় জা এর থেকে শুনলাম, ডায়রিটা নাকি ওর মেঝো ভাবির কাছে রাখছে। আমি ভাবির কাছে গেলাম গিয়ে বড়ভাবির নাম না বলে বললাম..
- আপনার দেবর নাকি আমার ডায়রিটা আপনাকে দিছে। ডায়রিটা দিনতো।
ডায়েরিটা অবশ্য দিলো, কিন্তু রাজ কে অনেক গালি গালাজ করলো।রাতে রাজ আসার সাথে সাথে উনিও এলো।এসে রাজকে অনেক কথা শোনালো, রাজ আমাকে ডায়েরির কথা বলেছে বলে। রাজ আমার ওপর এমনিতে রেগে ছিলো আরো রেগে গেলো মিথ্যে বলে ডায়েরিটা নিয়েছি বলে।
- ডায়েরি কোথায় রাখছোস দে।
- না দেবো না।
- দে বলছি।
- দেবো না।
এভাবে অনেকবার বললো।কিন্তু আমি ডায়েরিটা দিলাম না।সেদিন রাতে ঘরে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে আমাকে অনেক মারলো। আমি প্রচুর কান্না করছিলাম।আমার কান্না শুনে ওর চাচাতো ভাই এবং ভাবিরা এসে দরোজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে খুলে ফেললো।তারপর ওর বোন,মা এবং ভাবি সহ সবাইকে বকা দিয়ে আমাকে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেলো....
দুঃখীত গল্পটা দিতে লেট করে ফেলেছি,হঠাৎ করে কোনো প্লান ছাড়া বরিশালের কুয়াকাটা চলে আসলাম বেড়াইতে।ক্ষমাপ্রার্থী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন