গল্প:- ভুল সবই ভুল
২য় পর্ব
রাতে আমানকে নিয়ে আমি বিছানায় শুয়ে আছি তখন সন্ধি আমার ঘরে এলো। এসে আমার পাশে বসে কান্নাভেজা গলায় বললো,'ভাইয়ারে, অনেক কষ্ট দিছি তোদের! অনেক জ্বালাইছি।আর জ্বালাবো না। তোদের বাসা থেকে চলে যাবো। তুই ভাবীকে ফিরিয়ে নিয়ে আয় গিয়ে কাল।'
সন্ধি কাঁদছে।ওর কান্না আমার ভালো লাগে না। এমনিতেই ও খুব দুঃখী।স্বামী হারা মেয়েদের দুঃখটা শুধু স্বামীহারা মেয়েরাই কেবল বুঝতে পারবে।অন্যেরা এর সামান্যও আঁচ করতে পারবে না।
আমি সন্ধির মুখের উপর তাকালাম।ওর মুখের অবয়ব ঠিক মায়ের মুখের মতো।সন্ধিকে কষ্ট দেয়া মানে মাকেই কষ্ট দেয়া। আমার হঠাৎ মার কথা মনে পড়লো।মা যখন মারা গেলেন তখন সন্ধির পেটে ফুয়াদ।মা তখন মৃত্যুশয্যায় আমায় আর সন্ধিকে কাছে ডেকে নিলেন। তারপর আমার আর সন্ধির হাতটা একসাথে এক মুঠোয় নিয়ে বললেন,'মনসুর, তুই তোর বোনের হাত যেমনে এখন ধরছস এমনে সারাটা জীবন ধরে রাখবি।যেন তোর বোন কোনদিন দুঃখ কী জিনিস তা টের পেতে না পারে!'
সন্ধি তখন কাঁদছিলো হু হু করে।আমি তখন বলেছিলাম,'মাগো, তোমার ছেলে বেঁচে থাকতে তোমার মেয়ের কিচ্ছু হবে না।ওর ছায়া মায়া হয়ে সব সময় থাকবো আমি। পৃথিবীর কোন মন্দ শক্তি আমায় ওর কাছ থেকে দূরে সড়াতে পারবে না!'
মায়ের শেষ কথা ছিল,'তাই যেন হয়। এবার আমি মরেও শান্তি পাবো!'
আমি জানি না মা এখন কেমন আছেন! সন্ধির এ অবস্থা দেখে শান্তিতে থাকতে পারছেন কি না! কিন্তু আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে।ভয় হচ্ছে এই জন্য যে,মা যদি কোনদিন এসে আমায় স্বপ্নযোগে দেখা দিয়ে বলেন,'কি রে বাপ,তোর স্ত্রীর জন্য তো আমার মেয়ে কষ্ট পাচ্ছে!'তখন কী জবাব দিবো তাকে আমি!
সন্ধি আমার কাছে বসে আঁচলে মুখ গুঁজে হঠাৎ কেঁদে উঠলো।
আমি অস্থির হয়ে উঠে তাকে বললাম,'কী হলো আবার?কাঁদছিস কেন তুই?'
সন্ধি বললো,'ভাইয়া, তুই কী বিশ্বাস করেছিস এটা ভাবী যে বললো তার কপালে প্লেট ছুঁড়ে মেরেছি আমি?'
'না।আমি তো তোকে চিনি তুই আসলে কেমন।আর ওকেও চিনি ও কতটা নাটক জানে!'
সন্ধি এবার বললো,'ভাইয়া,ভাবী সন্ধ্যা বেলায় বললো ,সন্ধি, চুলোয় ভাত বসা গিয়ে।
আমি বললাম,ভাবী মাগরীবের নামাজটা পড়ে নেই। ওয়াক্ত চলে যাচ্ছে।
ভাবী তখন রেগে গিয়ে বললো,কাজের কথা শুনলেই নিরানব্বই টা বাহানা বাইর করে!মগা ভাই পাইছে একটা।অন্য কেউ হইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়া কবেই বাইর কইরা দিতো!
আমি তখন কোন উত্তর দিলাম না। সোজা বাথরুমে ঢুকে অজু করে বের হয়ে নামাজ পড়তে বসলাম। নামাজ থেকে উঠে দেখি ভাবীর কপাল ফাঁটা।আমি কাছে যেতে চাইলে তিনি বললেন, আমার কপাল ফাঁটাইয়াও জিদ মিটে নাই? এখন গলা টিপে মারতে চাস আমারে!
আমি এই কথা শুনে ভয়ে কেমন জড়ো হয়ে যেতে লাগলাম।আর ঘরে ফিরতেই ফুয়াদ আমার কাছে তখন বললো, মা মামী কী পাগল হয়ে গেছে?
আমি বললাম বাবা এসব বলছো কেন হঠাৎ।এসব বলতে নেই!
ফুয়াদ বললো, মামী না প্লেট দিয়ে নিজের কপালে আঘাত করেছে আগে। এখন তো রক্ত ঝরছে দেখোনি! পাগল ছাড়া তো কেউ এমন করে না মা?'
ফুয়াদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম আসলে কী ঘটেছে।'
সন্ধিকে আমি কাছে টেনে নিলাম।ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,'আমি তো জানি আমার বোন কেমন!মিতু যে ভালো মানুষ না সেটাও জানি। ওকে নিয়ে সংসার করা কঠিন হবে।আজ তুই চলে গেলে নতুন একটা সমস্যা দাঁড় করাবে। কিছু মানুষ আছে এমনই।যারা একটার পর একটা সমস্যা বাঁধিয়ে রাখতে আনন্দ পায়।'
সন্ধি আর কোন কথা বললো না। চুপচাপ উঠে তার ঘরে চলে গেল।
আমান কাঁদছে।গলা ছেড়ে কাঁদছে। ছেলেটা এখনও তার মায়ের দুধ খায়। হয়তো খিদে লেগেছে।আমি কত কী করলাম ওর জন্য।কোলে নিয়ে ঝাঁকুনি দিতে দিতে কত সুন্দর সুন্দর ছড়া কাটলাম এতে কোন ফল হলো না। অবশেষে সন্ধি এলো।সে এসে আমার কোল থেকে আমানকে নিয়ে গেল ওর ঘরে।একটু পরেই আমান শান্ত হয়ে গেল। তারপর সন্ধি এসে আমার কাছে বললো,'ভাইয়া,আমানের জন্য হলেও ভাবীকে ফিরিয়ে আনতে হবে।অত ছোট্ট মানুষ মা ছাড়া থাকতে পারবে না!'
সন্ধির কথার কোন উত্তর দেইনি আমি।সে যে আমানের চিন্তায় তার মাকে নিয়ে আসতে বলছে এখানে সেই আমানের মা এখানে এলেই যে তার এ বাড়িতে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়বে তা কিন্তু একটিবারও সে ভাবলো না।এমন সহজ সরল চিন্তার মানুষগুলোর আজীবন দুঃখ পেয়ে যেতে হয়।
রাত বাড়ছে। আমার চোখে এক ফোঁটাও ঘুম এলো না।মাঝ রাতে হঠাৎ করে শুনতে পেলাম সন্ধির ঘর থেকে কান্নার শব্দ আসছে।আমি জানি এখন সে কেন কাঁদছে। কাউকে এ কান্না দেখাবে না বলে।সন্ধি অনেকটাই চাপা স্বভাবের মেয়ে।চাপা স্বভাবের মেয়েরা মানুষকে শুনিয়ে শুনিয়ে কাঁদতে পারে না।এরা কাঁদে নীরবে নিভৃতে।
সকাল বেলা অফিসে যেতে রেডি হচ্ছি ঠিক তখন ফোন এলো মিতুর বড় ফুপুর। এই মহিলাই বিয়ের আলাপটা করেছিলেন আমাদের।উনি মিতুকে সেদিন ধুঁয়া তুলসি পাতার সাথে তূলনা করে বলেছিলেন,' পৃথিবীতে যদি একটি ভালো মেয়েও থাকে সে মিতু বৈ কি আর কেউ নয় বাবা!'
সেই মহিলার কথায় গলে গিয়ে মিতুকে বিয়ে করে আমার সর্বনাশ হলো!
বড় ফুপু ফোন দিয়ে বললেন,'মনসুর ,কাজটা কী ঠিক করলা বাবা?'
আমি অবাক হয়ে বললাম,'ফুপু বুঝতে পারলাম না আপনার কথাটা!'
'বোঝা লাগবে না।শুনো,একটা বুদ্ধি দেই তোমারে বাবা। পৃথিবীর তাবড় সংসারে একমাত্র ঝামেলা পাকায় রাখে কারা জানো?'
আমি বললাম,'কারা?'
'বোনেরা। এই আপদ বিদায় না করতে পারলে তুমিও কিন্তু সব হারাবা। আমার কথা তোমার তেতো লাগতে পারে এখন। কিন্তু একদিন দেখবা আমার কথাই খাঁটি ছিল। এই যে তোমার একটা ভাগ্নে আছে। এই ছেলে কিন্তু সারা জীবন ছোট থাকবো না।বড় হবে। এরপর শুরু হবে দখল। তোমার সবকিছু কাইড়া নিয়া তোমারে বানাইবো বান্দর। ওদের ইচ্ছে মতো তোমারে নাচাইবো তখন। তুমিও নাচতে বাধ্য থাকবা।না নাইচা তো উপায় নাই। সবকিছু নিয়া তো তোমারে তখন দেউলিয়া বানাইবো।পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু থাকবো না তোমার!'
এই মহিলা যে বড় খাটাস তা আমি জানি। জানি বলেই বললাম,'ফুপু, আপনিও তো ভাইয়ের কাছেই থাকেন। আপনার ছেলে দুটাও বড়ো হয়ছে। আপনি আর আপনার ছেলেরা মিলে কী আপনার ভাইকে বানরের মতো নাচান?'
কথাটা বলতে বলতে আমি হেসে ফেললাম।
ফুফু তখন চাপা রাগ দেখিয়ে বললেন,'তুমি আসলেই একটা বানর।লেজ দিয়ে খোঁচা দেয়া তোমার অভ্যাস। কিন্তু এর পরিণাম কত ভয়াবহ তা আমি তোমাকে বুঝাবো!'
আমি আবার হেসে বললাম,'কীভাবে বুঝাবেন ফুপু? অংকের মতো করে না গ্রামারের মতো করে?'
বড় ফুপু বললেন,'হারামজাদা ইতর!সময় এলেই টের পাবি আমি কিসের মতো করে বোঝায় এই বেয়াদবির পরিণাম তোকে!'
কথাটা বলেই ফোন রেখে দিল ফুপু।
ফোন রেখে আমি খানিক সময় হাসলাম। তারপর ভাবলাম, মিতুদের রক্তের সবগুলো মানুষই কী এক রকম!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন