জীবনের ভালোবাসা
পর্ব ০৯ শেষপর্ব।
১৫-১৬ দিন জব করার পর শুনলাম আমার শ্বশুর প্রচুর অসুস্থ। আমি ডিউটি করছিলাম দুপর বেলা রাজ আমায় কল দিয়ে বললো আব্বু প্রচুর অসুস্থ। এখনি বাড়ি যেতে হবে তুমি ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে আসো।সুপারভাইজার কে বললাম।উনি ছুটি দিলো না।পরে লাইনসিপের কাছে গেলাম কিন্তু তাতেও কাজ হলো না।শেষে পি এম স্যারের কাছে গেলাম। ছুটি চাওয়াতে উনি বললো মরে নি তো।মরলে যেয়ো।চাকরি করবো না বলে গেটপাস নিয়ে চলে আসলাম।ও ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে ছিলো।আমি অফিসের কাছে থেকেই গাড়িতে উঠলাম।আমরা যতক্ষণে বাড়ি পৌছালাম ততক্ষণে আব্বু মারা গেছে।
হারিয়ে ফেললাম একজন ভালোবাসার মানুষকে।বিয়ে করে আসার পর এই মানুষটিই সবসময় আমার পাশে ছিলো।ভালোবাসতো আমাকে নিজের মেয়ের থেকেও বেশী। আমার কোনো কাজের জন্য কোনো অভিযোগ করেন নি।যাইহোক উনার আত্মার মাখফিরাত কামনা করি।আব্বুর মৃত্যু উপলক্ষ্যে ওখানে ৭ দিন থাকলাম।শ্বশুর বাড়ির সবার সাথে আমার সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
৭ দিন পর সবাইকে বিদায় জানিয়ে আবারো বের হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।ঢাকা গিয়ে রাজ ওর কর্মস্থলে যোগ দিলো। আর আমি বাসায়। কারন তখন মাসের শেষ। কোথাও নিয়োগ নেই।তাই বাধ্য হয়েই বাসায় থাকতে হলো।
বাসায় আসার কিছুদিন পর,হঠাৎ বিকেল বেলা আমার ফোনে অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা কল আসে, প্রথমে রিসিব করতে চায়নি অপরিচিত বলে,পরে কি না কি ভেবে আবার রিসিভ করলাম।দেখলাম আগের ফ্যাক্টরির লাইনসিফ ফোন করেছে।জানতে পারলাম উনি এখন অন্য একটা ফ্যাক্টরি তে জব নিয়েছে। সেখানকার নিয়মকানুন গুলোও খুব ভালো।সাথে উনি এটাও বললেন আমি চাইলে সেখানে জয়েন করতে পারি।দিন ছিলো মাসের শেষে ৩০ তারিখ।উনার কথামতো আমি পরের দিন গেলাম ইন্টারভিউ দিতে।ইন্টারভিউ দেওয়ার পর আমার বেতন ধরা হলো ৮,০০০টাকা।বেতন,নিয়মকানুন সবই আমার ভালো লেগে গেলো।কিন্তু সমস্যা হলো আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে ফ্যাক্টরিটা অনেকটা দুরে।১মাস ডিউটি করলাম ওখান থেকেই।সাথে সাথে লাঞ্চ টাইমে বাসা খুজতে লাগলাম।পেয়েও গেলাম একটা মনের মতো বাসা।পরের মাসের ১তারিখে চলে আসলাম সেই বাসায়।এটা ছিলো চন্দ্রাতে।ভালোই ছিলাম বাসাতে চলে গেলো প্রায় ১.৮ বছর। খুবই সুখে ছিলাম স্বামী,চাকরি আর বাসার সবার সাথে।কিছুদিন পর বাসার গ্যাস কেটে দিলো সরকারের অনুমতিতে।সব বাসার মালিক বাসা ভাড়া কমালো।কিন্তু আমাদের বাসাওয়ালা কাকু বাসা ভাড়া কমাতে নারাজ।তাই বাধ্য হয়ে অন্য বাসায় গেলাম।
সেই বাসার সকল ভাড়াটের সাথে মিল না হলেও বাসাওয়ালা সহ তিন চারজনের সাথে প্রচুর মিল হলো।সারাদিন ডিউটি করে আসার পর আমি যখন টিভি ছেড়ে তরকারি কাটতে বসতাম তখন সবাই এসে আমাকে ঘিরে বসে নানা ধরনের গল্প করতো আর পাশাপাশি আমার কাজে সাহায্য করতো।
এমনই ১ দিন আমি সন্ধ্যা ৭ টায় অফিস থেকে এসে ডাল রান্না করবো বলে পেয়াজ মরিচ আর শলুক পাতা কাটছিলাম।দিনটি ছিলো রবিবার ১৫ই জানুয়ারি ২০১৭ সাল।
পাশে ভাবিরা বসে লাউ শাক কেটে দিচ্ছিলো।মনটা সকাল থেকেই খারাপ ছিলো ভাবিরা আমাকে বলছিলো কিরে বাড়ি থেকে এসে সবাই হাসি খুশি থাকে।আর তুই এতো মনমরা হয়ে আছিস কেনো?
- জানি না। কেনো জানি ভালো লাগতাছে না।
কথাটা বলতে না বলতেই আমার ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো।রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে কেউ বললো।
-ভাবি আমি সবুজ।
- কোন সবুজ?
-রাজ ভাইয়ের সাথে যে কাজ করি সেই সবুজ।
-ওহ আচ্ছা কেমন আছেন?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উনি আমাকে বললো.....
-আসলে ভাবি একটা কথা ছিলো।
- হুম বলুন।রাজ ভাই অসুস্থ আপনার সাথে কথা বলতে চাই।
ওর অসুস্থতার খবর শুনে আমি কাঁদতে শুরু করলাম। আমার কান্না দেখে ভাবিরা আমাকে জিজ্ঞেস করলো...
-কিরে কি হয়ছে তুই এতো কাঁদছিস কেনো?
- রাজ নাকি অসুস্থ আমার সাথে কথা বলতে চায়?
-তো বলছিস না কেনো?
- রাজের অসুস্থতারর কথা শুনে আমি এতোটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে ওর সাথে কথা বলার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।
কল দিতে যাবো এমন সময় কল আসলো রিসিভ করে বললাম। রাজকে দিন।
সবুজ ভাইয়া তখন বললো রাজ অনেক অসুস্থ। কথা বলার অবস্হায় নেই।আপনি এখনি চলে আসেন এখানে।
এই কথা শুনে আমি আবারো কান্না করতে লাগলাম।পরে ঐ বাসার ই একটা ভাইয়াকে বললাম আমার সাথে যেতে।কাছে টাকা ছিলো না।বাসার তিনটা ভাবি মিলে আমাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বললো। হসপিটালে নিয়ে যেতে বলো।তারপর আমরা আসতেছি।গাড়িতে ওঠার জন্য ঐ ভাইয়াকে সাথে নিয়ে ওর দোকানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকায় গাড়ি পাচ্ছিলাম না।প্রায় ২০মিনিট দাড়িয়ে থাকলাম,তবুও গাড়ি পেলাম না।শেষে হেটে হেটেই যাচ্ছিলাম।কিছু রাস্তা যাওয়ার পর বাসা থেকে আরো ৬জন আসলো।তারপর ওরা আমার ফোনটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম কেনো আমার ফোনটা আমার কাছ থেকে কেড়ে নিলেন?আর কেনোই বা আপনারা সবাই আসলেন।উনারা আমাকে বললো কান্না করিস না।রাজ এখন সুস্থ আছে।আমরা ওকে আনতে যাচ্ছি। একটা চারচাকা সি,এন,জি ভাড়া করা হলো।আমার মন কিন্তু ওদের কথা শোনে নি।
রাজকে নিয়ে এসে কালই বাড়ি চলে যাবো।তারপর কোনো একটা বড় ডক্টর দিয়ে ওকে দেখাবো।(মনে মনে কথাগুলো ভাবছিলাম।)
৯ টা বেজে গেলো দোকানে পৌছাতে। গাড়ি থেকে নামতেই অনেক মানুষ জিজ্ঞেস করলো কোনটা রাজের বউ।তখন কেউ একজন আমাকে দেখিয়ে দিলো।মানুষটার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসলো আহারে এতো কম বয়সে মেয়েটাকে বিধবা হতে হলো।কথাটা আমার কানে আসলো।আমি রাস্তা পার হচ্ছিলাম রাস্তার মাঝেই পড়ে গেছিলাম।রাস্তায় তখন গাড়ি ছিলো।
না আমি মরি নাই, দূর্ভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে গেছিলাম।কিছুক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরলো। তখন কয়েকজন আমাকে নিয়ে গেলো আমার বরকে দেখাতে। কাছে গিয়ে দেখলাম রাজ শুয়ে আছে। অনেক প্রশ্ন করেছিলাম সেদিন।চিল্লাই ছিলাম অনেক জোরে।তবুও রাজ আমায় থামতে বলেনি।একটা কথাও বলেনি, রাত ১১টা বাজে ওর চাচাতো ভাই এবং বোন আসলো এসে ওর মৃত দেহ ভালো করে দেখলো।ওর বুকে কয়েকটা দাগ ছিলো।এটা নিয়ে ওখানে অনেক ঝামেলা হলো।পরে জানা গেলো ও নাকি পরে গেছিলো কাঠের স্তুপের উপর।
নিয়ে আসা হলো ওকে বাড়িতে।পরের দিন বিকেল তিনটায় জানাজা নামাজ সম্পন্ন করে ওর কবর দেওয়া হলো।পরে রইলাম শুধু আমি জিন্দা লাশ হয়ে।
আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন?আমি পরের মেয়ে হয়ে নিজে ইনকাম করার পর ও কেনোকিছু চাইনি।
সেখানে ওর ভাই ওকে কবর দিয়ে এসেই আমার রুমের বাক্সের তালা ভেজ্ঞে ফেললো।এ নিয়ে পাড়াপড়শি অনেক অনেক কথা বললেও থামেন নি উনি। বাক্সে যা ছিলো বের করে নিলো।সেই দিনটা এমনি করেই চলে গেলো।আমি কিছু খাচ্ছি না। মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি সেদিকে ওদের খেয়াল নেই। ওরা পরে আছে আমি পরে বিয়ে করবো কিনা সেটা নিয়ে।
সেদিন ওখানেই পরে রইলাম নিস্তেজ হয়ে।
পরের দিন আমার সেজো ভাইয়া ডক্টর নিয়ে গেলো।ডক্টর আমাকে স্যালাইন পুষ করে দিলো।সাতদিন আমাকে স্যালাইনের উপরই রাখা হলো।স্যালাইনের দাম আমাদের বাড়ি থেকে দেওয়া হলো।অথচ তখন আমার ননদের কাছে আমাদের নগদ ৯০হাজার টাকা ছিলো।আর ওর বড় ভাইয়ের কাছে ছিলো,২লক্ষ টাকা।উনার কাছে অবশ্য নগদ ছিলো না।কিছুদিন পর ওর আত্মার মাখফিরাত কামনার জন্য মিলাদের আয়োজন করা হলো।আয়োজন শেষে সবাই যখন আমার হক আমাকে দিয়ে দেওয়ার কথা বললো।তখন ওর বড় ভাই ঘোর আপত্তি জানালো।এ নিয়ে অবশ্য অনেকে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।উনি মুখের ওপর সোজা বলে দিয়েছিলো জুই তো কয়েকদিন পর নতুন কাউকে বিয়ে করবে।তখন আমার ভাইয়ের টাকার কথা মনে থাকবে না।+ আমার ভাইকে দুয়া ও করবে না।আমার বাচ্চা কাচ্চারা তার চাচার টাকা খেয়ে সারাজীবন দুআ করবে।এসব শুনে আব্বু আমাকে নিয়ে আসলো বাড়িতে।আমিও চলে আসলাম শ্বশুরবাড়ির মায়া ত্যাগ করে।
তারপর অবশ্য আমার চাচাশ্বাশড়ি তার ছেলের জন্য বউ করে আমাকে নিতে চাইছিলো।সৌভাগ্যক্রমে আমি আর আমার পরিবার রাজি না হওয়ায় বিয়েটা হলো না। অবশ্য ওই ভাইয়া খুব ভালো ছিলেন।সেই সাথে শিক্ষিত ছিলেন, এবং চাকরিজীবী ও ছিলেন।আমি ওখান থেকে আসার পর প্রায় অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম।কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যেতাম।আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার নিজের ভাসুর, দেবর আর ননদ ছাড়া বাকি সবাই আমাকে দেখতে আসতো।
একদিন আমার ঐ ভাসুর যিনি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন তিনি এসে আমার এই অবস্থা দেখে উনার পরিচিত একজন সাইকিয়াস্টিক এর কাছে নিয়ে যান।উনার চিকিৎসা আর সকলের ভালোবাসায় আমি সুস্হ হয়ে গেলাম।সুস্হ হওয়ার পর আমি আবার লেখাপড়া শুরু করলাম।চলতি বছরে আমি এইচ,এস,সি দিয়েছি।এর মাঝে অবশ্য অনেক সমন্ধ এসেছিলো কিন্তু আমি বিয়ে করিনি।কারন আমি আরো স্টাডি করতে চাই।আমি কিন্তু এখনো রাজকে ভুলে যাইনি।এখনো রাজ আমার হৃদয়ে বসত করে।এখনো আমি কাঁদি।আর কেনো কাঁদি জানেন? রাজের সাথে কাটানো সুখের মূহুর্ত গুলোর জন্য।আমার জীবনের মোড় ঠিক দুইবার পাল্টে গেছে। নতুন করে আর কখনো পাল্টাবে কি না জানি না।তবে আমার মনে হয় জীবনও ঠিক নদীর মতো মোড় নেয়।
------সমাপ্ত------
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন